দাদু নেই আর

 শৈশবে যার হাত ধরে, যার আদরে বেড়ে উঠি, যদি আমার জীবনকালের একমাত্র সুখের স্মৃতির পাতা কেউ আমাকে খুঁড়ে আনতে বলে তাহলে একটা মাত্র নাম আমার মন থেকে ওঠে আসবে, - দাদু। আমার বাপের বাপ। দাদুর মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আজ দাদু বিহীন একটি দিন। . সম্পর্কের সূতোর মতো এমন অভেদ্য সূতো জগতে আর একটিও নেই। ভালোবাসা বুকের নিবিড় জমিনে বেড়ে উঠে সযত্নে। আমাদের সম্পর্ক একদম নাভীমূল থেকে উৎসারিত ছিলো এই সত্যটুকু আমরা জানি দাদু, তাই তোমার অস্তিত্বহীনতা নিয়ে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভালোবাসাতো পাত্র বিচারে হয়না, উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিও মুখ্য নয়। ভালোবাসা ভালোবাসারই মত চিরন্তন বহতা নদীর স্রোত—সে জানে না নদীর অপারগতা কিংবা চরের দুর্দণ্ড প্রতাপশালী মনোভাব। ভালোবাসা কেবল বহিয়াই চলে, কেবল বহিয়াই চলে। . কেউ যেনো ভুল করেও তোমার উপর বিরক্ত না হয় এরকম একটা দিনে তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিলে—একেবারে চুপচাপ, কাউকে তোমার কষ্ট বুঝার আক্ষেপটুকু পর্যন্ত না দিয়ে। কে জানে, পিছে আবার কে বিরক্ত হয় তোমার শেষবেলাতে? জগতে তুমিতো কম দেখোনি মানুষের প্রতাপী মুখ। তোমার গর্ভের সন্তানেরা পর্যন্ত তোমাকে কম শেখায়নি, দাদু। তুমি একদম বুদ্ধিমানের ম...

শ্রাবণ

১.
শূন্যতার অর্থ জানো তুমি? অনুপস্থিতি মানেই শূন্যতা নয়। কাছাকাছি থেকেও কাছে না পাওয়ার হাহাকারটুকুই শূন্যতা। আমার কথা শুনে তুমি ভুবন ভোলানো হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে বললে, তাই বুঝি কাছে আসতে ভয় পাও? দূরত্ব নির্মাণ করে যাও, নৈকট্য লাভের আশায়! আমি বললাম, দূরত্ব কখনো নির্মাণ করা যায় না, দূরত্ব তৈরি হয়। নির্মাণ করা যায় নৈকট্য।
তুমি কিছু বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলে। তোমার মুখের উজ্জ্বল রোদ্দুরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল, ওখানে মেঘের ঘনঘটা! তোমার সাথে প্রকৃতিও যেন জোট বেঁধেছে। শ্রাবণের আকাশ আজ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ ছড়িয়ে আকাশ জুড়ে মেঘেদের ছুটোছুটি। বৃষ্টির সুবাসে মন মাতাল! ‘এমন দিনে তারে বলা যায়...’। অথচ দেখো এমন মেঘমেদুর বরষায় আমাদের শব্দগুলো, কথাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়! এমন দিনে কিছুই বলা হয় না। বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে ফোঁটায় ফোঁটায়...। মুক্তোদানার ঝিরিঝিরি বর্ষণে ভিজে যাচ্ছে চরাচর। বৃষ্টির জলে অথবা চোখের জলে সব ঝাপসা হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তোমার মুখটাও মিলিয়ে যায়...! খুঁজে পাই না আর তোমাকে।
২.
দূর গাঁয়ে আমার ছোট্ট কুটির। নাগরিক কোলাহলের উৎপাত নেই। আছে নীরবতার স্নিগ্ধতা! উঠোনে বেড়ে ওঠা জারুল, চালতা আর কদম গাছগুলোর সাথে আমার দারুণ সখ্যতা! বিশাল ডালপালা ছড়িয়ে গাছগুলো উঠোনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। স্থবির। তবু কত প্রাণময় তারা! বর্ষা এলেই ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছগুলো। এসব রূপ মাধুর্যে বুঁদ হয়ে অনায়াসে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। উথাল-পাথাল জোছনা রাতে মেঠো পথ বেয়ে চলে যাই নদীর ধারে। ছোট ছোট ঢেউগুলোতে চুমু খেয়ে যায় ঝকমকে চাঁদনী রাত। আনন্দের ঝিলিক জাগে নদীতটে। কখনো বা মেঘ নামে। চাঁদ মুখ লুকায়। তুমুল বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট-পথ-প্রান্তর সজীবতায় সিক্ত হয়। বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতি স্নিগ্ধতা ছড়ায় চারপাশে। তবু এক টুকরো শুষ্কতা টের পাই শুধু আমি! বৃষ্টিতে সব শুষ্কতা ভেজে না কেন, বলতে পারো?
তুমি বলেছিলে, ঝুম্ বৃষ্টিতে ভিজতে হয় প্রিয় মানুষটির হাত ধরে। বৃষ্টিতে যে সুর থাকে, যে কথা থাকে, যে বাসনা থাকে, তা দুজন মানুষের ভেতরে নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে দেয়। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, স্বপ্নটুকু জাগিয়ে দেবার দায়িত্ব বৃ্ষ্টির, কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করে দেবার কোনো দায় নেই বৃষ্টির—সে দায়টুকু শুধু ওই দুজন মানুষের। বৃষ্টিসিক্ত স্বপ্নগুলো যদি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায় দূর দেশে, আর যদি না-ই ফেরে, তৃষ্ণার্ত চাতকের তৃষ্ণা মেটায় কার সাধ্যি! জলের আশায় দিন গুনতেই থাকে চাতক, তবু দিন ফুরায় না!
আজকাল প্রায়ই বৃষ্টির শব্দ পাই। বাইরে বৃষ্টি নেই, অথচ ভেতরে বৃষ্টি ঝরে...!
৩.
পাথর ছড়ানো পথে আমি বহুদূর হেঁটে গিয়েছি, পথের শেষ দেখবো বলে নয়—শুধু পথিক হব বলে। পথ আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। পথিক করেছে আমাকে। অথচ আমি কী দিয়েছি পথকে? কিছুই না! সবকিছুর বিনিময় হয় না। কোনো কোনো দানের প্রতিদান হয় না। অথচ মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিনিময়ের দৌরাত্ম্যটা প্রবল। পারস্পরিক সম্পর্ককে ঘিরে জীবনের সব লেনদেন হয়তো একদিন ফুরায়, তবু সব হিসেব মেলানো যায় না শেষ পর্যন্ত! তুমি বলেছিলে, একটা জন্ম আর কয়টা সাধ মেটাতে পারে! জীবন কখনো স্বপ্নের সমান হয় না। আমাকে তুমি শুনিয়েছিলে হুমায়ূন আজাদের সেই কবিতাটি —
‘অজস্র জন্ম ধরে আমি তোমার দিকে আসছি; কিন্তু পৌঁছোতে পারছি না।
তোমার দিকে আসতে আসতে আমার এক-একটি দীর্ঘ জীবন
ক্ষয় হয়ে যায় পাঁচ পয়সার মোমবাতির মতো।
আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে।
একজন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার দুঃখ তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।
আরেক জন্মে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম তোমার উদ্দেশে।
পথে বেরিয়েই পলিমাটির ওপর আঁকা দেখি তোমার পায়ের দাগ।
তার প্রতিটি রেখা আমাকে পাগল ক’রে তোলে।
ওই আলতার দাগ আমার চোখ আর বুক আর স্বপ্নকে এতো লাল ক’রে তোলে
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ণ ভুলে যাই। ওই রঙিন পায়ের দাগ
প্রদক্ষিণ করতে করতে আমার ওই জন্মটা কেটে যায়।
আমার দুঃখ মাত্র একটি জন্ম আমি পেয়েছিলাম সুন্দরকে প্রদক্ষিণ করার।
আরেক জন্মে তোমার কথা ভাবতেই আমার বুকের ভেতর থেকে
সবচেয়ে দীর্ঘ আর কোমল আর ঠাণ্ডা নদীর মতো কী যেন প্রবাহিত হ’তে
শুরু করে। সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে আমি
একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে কাটিয়ে দেই সম্পূর্ণ জন্মটা।
আমার দুঃখ আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিলো মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ।
আমার ষোড়শ জন্মে একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে।
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি—উঁচুতে—উঁচুতে,
আরো উঁচুতে--; আর এক সময় ঝ’রে যাই চৈত্রের বাতাসে।
আমার দুঃখ মাত্র একটি জন্ম আমি গোলাপের পাপড়ি হয়ে তোমার উদ্দেশে
ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিলাম।
এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে টলমল করছে একটি অশ্রুবিন্দু।
ওই অশ্রুবিন্দু পেরিয়ে এ-জন্মে হয়তো আমি তোমার কাছে পৌঁছোতে পারবো না।
কেনো পৌঁছাবো? তাহলে আগামী জন্মগুলো আমি কার দিকে আসবো?’
৪.
ঘনমেঘে আকাশ ভরপুর আজ। সকাল থেকেই মন কেমন করা হাওয়ায় ভাসছে চারপাশ। এমন বরষার দিনে কেন জানি বড় একলা-একলা লাগে! আকাশ ছাপিয়ে তুমুল বৃষ্টিটা যখন ঝমঝমিয়ে নামলো আমার উঠোনে, খুব ইচ্ছে হলো তোমার কাছে যাই। ঠিক এমন সময় তুমি ঝুপ্ করে নেমে এলে মুঠোফোন বেয়ে। বৃষ্টিজলে ধুয়ে যাওয়া আমার উঠোনে তখন শ্রাবণের হুটোপুটি! তুমি বললে, এইমাত্র সমুদ্ররাজ্যে পৌঁছালাম। আমার রুমের জানালাটা খুলতেই বৃষ্টিমাখা সমুদ্র যেন ঢেউ খেলে আমার ঘরে এলো! দারুণ বৃষ্টি! পুরো আকাশ বুঝি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে! এমন সুন্দর বৃষ্টি একা একা দেখা যায় না। তোমার শহর থেকে সমুদ্রশহর, কত আর দূরত্ব! তুমি এখনই চলে এসো। মনে মনে ভাবলাম, দূরত্বটা খুবই ছোট, কিন্তু কোনো কোনো দূরত্ব কখনোই পারি দেওয়া যায় না। যতই ছুটতে থাকি, দূরত্বটাও সমান দূরত্ব নিয়েই ছুটতে থাকে...!

Comments

Popular posts from this blog

ব্যথার আদরে অবুঝ আঙুল রাখলাম

দাদু নেই আর

ভালবাসার গুরুত্ব